বিয়ে

 সকালবেলা অফিসের উদ্দেশ্য বের হতেই পিছন থেকে বাবার ডাক,

— এই প্রিতম, এদিকে আয় (বাবা)

— কি বলবা জলদি বলো, অফিসে লেট হয়ে গেছে (আমি)

— তিন তলার নতুন ভাড়াটে এসেছে, দেখেছিস?

— হুম, কেন?

— মেয়েটাকে দেখেছিস? ভারি মিষ্টি

— মা.....মা...... এদিকে এসোতো (চিৎকার করে)

— কিরে, পাগলা ষাড়ের তাড়া খাইছিস নাকি? চেচাস কেন? (মা)

— পাগলা ষাড় না, চরিত্রহীন ষাড় (আমি)

— মানে?

— এইযে, তোমারটা ৷ বুড়ো বয়সে হাটুর বয়সি মেয়েদের দিয়ে মিষ্টি নজর দিয়ে বেড়াচ্ছে

— কি..!! তবেরে, আজ দুপুরে ভাত বন্ধ

— আরে মানেটা কি? আমার কথাটা তো শুনবে... (বাবা)

— কোন কথা শুনবে না মা ৷ তুমি এই লোকটারে ডিভোর্স দিয়ে দাও, আমি তোমার জন্য অনেক ভাল ছেলে এনে দেবো

— দাঁড়া তোর ডিভোর্স দেওয়াচ্ছি...

টিভির রিমোটটা উচিয়ে তাড়া করলো আব্বাজান ৷ আমিও লেজ উচিয়ে দিলাম ভো দৌড় ৷ এক দৌড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম ৷ এটা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয় ৷ বাবা, মা এবং আমার ছোট পরিবারে তিনজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতই ৷ বেশ কিছুদিন ধরে বাবা আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছে, আজও সেজন্যই ওই মেয়ের কথা বলছিল, তাই উল্টে বাবাকেই কেস খাইয়ে দিলাম ৷ এখন মাকে যতই বোঝাক, দুপুরে তার বাড়ির ভাত জুটবে না ৷ পিছনে একবার তাঁকিয়ে নিলাম, না আসছে না ৷ অদূরেই একটা রিকসা দেখে ডাক দিলাম

— মামা যাবেন? (আমি)

— কই যাইবেন মামা? (রিকসাওয়ালা)

— ট্রেড মোড়

— জী ওঠেন

আমি রিকসায় উঠে বসলাম ৷ হটাৎ কোথা থেকে হন্তদন্ত করে একটা মেয়ে উঠে বসলো আমার পাশে ৷

— তাড়াতাড়ি চলেন আঙ্কেল (রিকসাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল মেয়েটা)

— ওই, কে আপনি? আমার রিকসায় উঠেছেন কেন? (আমি)

— এটা আপনার রিকসা? আপনাকে দেখে তো মনে হয়না রিকসা চালান

— আজব! আমি রিকসা চালাতে যাবো কেন? আমি অফিসে যাওয়ার জন্য রিকসা ভাড়া নিয়েছি

— আমার কলেজ আপনার অফিসের আগেই, তাই উঠলাম

— আমার অফিস কোথায় আপনি কেমনে জানলেন?

— আপনি বললেন একটু আগে

— যাই হোক, আমি ওনাকে ডেকেছি, আমি একাই যাবো

মেয়েটা রিকসাওয়ালাকে বলল,

— আঙ্কেল, দুজন নিয়ে যেতে আপনার সমস্যা আছে

— আমার আর কি সমস্যা, আমার সমস্যা নেই (রিকসাওয়ালা)

এবার মেয়েটা আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে বলল,

— যার রিকসা তার সমস্যা নেই, আপনার এতো সমস্যা কিসের? চুপ করে বসে থাকেন, আর নাহয় নেমে যান ৷ আর একটাও কথা বললে কিন্তু আমি চিল্লাবো

অগত্যা চুপ করে বসে রইলাম ৷ রিকসা চলতে শুরু করলো ৷ মেয়েটার দিকে আড়চোখে একবার তাঁকালাম ৷ মোটা গোল ফ্রেমের চশমা পরা ৷ ছাত্রি নাকি ম্যাডাম বোঝা গেলোনা ৷ তবে কপালের কালো টিপটা বেশ মানিয়েছে ৷

সিটি কলেজের সামনে এসে রিকসা দাঁড় করালো মেয়েটা ৷ নামতে নামতে বলল,

— ভাড়াটা দিয়ে দিয়েন, আসি (মেয়েটা)

— চিনিনা জানিনা আপনার ভাড়া আমি কেন দেবো? (আমি)

— ওকে, আমি মেঘা, আপনাদের বাসার তিন তলায় থাকি, এই কলেজে বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে পড়ি ৷ হয়েছে? এবার বিদায় হন

কথা শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল মেয়েটা ৷ তার গমন পথের দিকে কিছুক্ষণ হা করে তাঁকিয়ে থেকে আমিও আমার গন্তব্যে রওনা দিলাম ৷ এই তাহলে সেই মেয়ে, বাবা যার কথা বলছিল সকালে ৷ দেখতে আখের গুড়ের মত মিষ্টি হলেও ভেতরে পুরো মরিচের চপ, খাইলেই মাথা চুলকানি শুরু হয়ে যাবে ৷ আবাক হওয়ার কিছু বলিনি, আমি ঝাল একটু কম খাই, বেশি খেলেই চুলের গোড়া জ্বলে ৷

দুপুরে বাড়িতে এসে আমার চক্ষু চড়কগাছ ৷ একি দেখছি আমি ৷ ভাল করে চোখটা ডলে নিলাম ৷ কিন্তু দুহাতে চোখ লাল করেও দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হলো না ৷ বাবা খাচ্ছে, আর মা বেড়ে দিচ্ছে ৷ চব্বিশ বছরে এ ঘটনা এই প্রথম ৷ এর আগে যতবার মা বাবার ভাত বন্ধ করার কথা বলেছে, ততবার সেটা কার্যকর করতেও দেখেছি ৷ ভাল করে বাবার মুখের দিকে তাঁকালাম ৷ বাবার মতই তো লাগে, বাবার কোন জমজ ভাই আছে বলে তো শুনিনি, তাহলে তো বাবাই ৷

— কিরে, ওখানে হা করে দাঁড়িয়ে থাকলে কি খাবার উড়ে গিয়ে মুখে পড়বে? ফ্রেশ হয়ে খেতে আয় (মা)

ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম ৷ বাবা আমার দিকে তাঁকিয়ে মিটিমিটি হাসছে ৷ বিজয় আর খোচা একসাথেই প্রকাশ পাচ্ছে সে হাসিতে ৷ চুপচাপ খেয়ে অফিসে চলে আসলাম ৷

রাতে বাড়ি ফিরে দেখি সারা বাড়ি ডেকোরেশন করা হচ্ছে ৷ হটাৎ কিসের অনুষ্ঠান বুঝলাম না ৷ ঘরে ঢুকেই মাকে জিগ্গেস করলাম,

— বাড়িতে কিসের অনুষ্ঠান? (আমি)

— বিয়ে ৷ তিনতলার মেয়েটাকে দোতলায় আনা হবে (মা)

— মানে? তুমি এটা মেনে নিছো?

— হ্যা, না মানার কি আছে?

— তুমি এই বয়সে সতিনের ঘর করবে? আর ওই মেয়েটা পুরাই দজ্জ্বাল

— একটা চড় খাবি ৷ আমার সতিন হবে কেন? বৌমা হবে

— এ্যা? হে হে হে, আমি বিয়ে করছিনা

— হে হে করে লাভ নেই, কালকেই বিয়ে

— আমি বিয়ে করবোনা মা

— চুপ, বড্ড বেশি কথা বলিস, ঘরে যা

— আচ্ছা আমি মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাই

— যা বলার বাসর ঘরে বলিস, এখন যা তো, বিরক্ত করিস না, অনেক কাজ

এতক্ষণে বুঝলাম বাবার ভাত কেন বন্ধ হলোনা দুপুরে ৷ যাই হোক, চুপচাপ বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম ৷

উফফ! সারাদিন যে ধকল গেল ৷ এতো কষ্ট করে বিয়ে করা যায় নাকি? বন্ধুবান্ধবের থেকে বিদায় নিয়ে বাসর ঘরের সামনে দিয়ে দাঁড়ালাম ৷ দরজাটা হালকা ফাক করে ভেতরে উুকি দিলাম ৷ মাথা নিচু করে শান্ত পুতুলের মত বসে আছে মেঘা ৷ উু উু করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে ৷ নয় মাস ধরে কত রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা আনলাম, আর এই মেয়েটা আটচল্লিশ ঘন্টার সাইক্লোনে তা উড়িয়ে নিয়ে গেল ৷ হটাৎ কাজী নজরুল এসে ভর করলো মাথার উপর ৷ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই চিৎকার করে বলতে শুরু করলাম,

— বল বীর, বল উন্নত মাম শীর,

শীর নেহারি আমারই এই নত শীর ঐ শিখর হিমাদ্রির

মেয়েটা প্রথমে একটু ধড়ফড় করে উঠলো ৷ বুকের মধ্যে একরাশ থু থু দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো ৷ তারপর টেবিলের উপর থেকে ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে সোজা আমার গলার সামনে ধরলো,

— আর একটা শব্দ বের হলে গলার নলী কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো (মেঘা)

আমি ভয়ে ভয়ে ইশারায় বললাম যে ঠিক আছে ৷

— সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়, সারাদিন অনেক ধকল গেছে, এখনি ঘুমাবি, নইলে খবর আছে

আমি শান্ত ছেলের মত শুয়ে পড়লাম ৷ একটু পর মেঘা লাইট অফ করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো ৷ জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে ৷ আবছা আলোয় আমি মেঘার হাতের উপর হাতটা রাখলাম ৷ এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল, বেশ রেগে আছে বুঝলাম ৷ তাই আর কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়লাম ৷

রাতে হটাৎ বুকের উপর ভারি কিছু অনুভব করে ঘুম ভেঙে গেল ৷ চোখ খুলে দেখি মেঘা আমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ৷ চাঁদের আলো এসে পড়ছে ওর মুখের উপর ৷ কাল প্রথম দেখাতেই যে ভাললাগা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা যেন এই আবছা আলোয় বহুগুণ বেড়ে গেছে ৷ মেঘার কপালে আলতো করে একটা আদর দিলাম ৷ একটু নড়েচড়ে সেভাবেই শুয়ে থাকলো ৷ মাথায় হাত রেখে আস্তে করে ডাক দিলাম

— মেঘা...

সাথে সাথে একটা আঙুল আমার ঠোটের উপর চেপে ধরলো মেঘা ৷ তারমানে জেগে আছে ৷ অজান্তেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো আমার ৷ প্রকৃতই এক অজানা সুখ আছে এই হাসির মাঝে ৷ তার সন্ধান করার একফোটাও কৌতুহল নেই ৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মেঘাকে ৷ আজ রবি ঠাকুরের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে,

"পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম"

-------------------- সমাপ্ত

#

মন্তব্যসমূহ